বিগত সরকারের ভুলের চরম খেসারত

মেজর আখতার (অব.): মানুষ কখনই ভুল জেনেশুনে করে না। ভুল যখন করা হয় তখন তা যে ভুল হয়েছে তা যিনি করেন তিনি মেনেও নেন না। বরং ভুল ধরিয়ে দিলে বা ভুল হচ্ছে বললে যে বলে তার ওপর উল্টো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কিন্তু ভুল ভুলই। ভুলকে কখনই অস্বীকার করার জো নেই। ভুলের মাশুল দিতেই হবে। ভুল শুধু ব্যক্তিজীবনেই সীমাবদ্ধ নয়; ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতির ভুল হতে পারে এবং হয়। তাই ভুলের খেসারত যেমন ব্যক্তিকে দিতে হয়, তেমনি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দেশ তথা জাতিকেও দিতে হয়। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরের ভুল ধ্বংস ও বিপর্যয় ডেকে আনে। এমন অনেক ভুল আছে যার সংশোধন করা আর কখনই সম্ভব হয় না। এজন্য বলা হয়, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।

 

ভুল কিন্তু শুধু একাই কেউ করে না। প্রতিটি ভুলের পেছনে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একপেশে স্বার্থ, অতিলোভ এবং ব্যক্তির দাম্ভিকতা প্রচন্ড ভাবে কাজ করে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা ব্যক্তির চারপাশে এমন একটি পরিবেশ ও অবয়ব সৃষ্টি করে যে, ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না, সে ভুল করছে। সব ভুলের কেন্দ্র কিন্তু ব্যক্তি। ভুলটা ব্যক্তিই করে। কিন্তু তার চারপাশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চাটুকার ও তাঁবেদাররা ব্যক্তিকে বুঝতেই দেয় না যে, ব্যক্তি ভুল করছে বা ভুল করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তি অনেক সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট চাটুকার ও তাঁবেদারের কারণে ভুল করতে বাধ্য হয়। মানবজীবনে ভুল একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় যা থেকে কোনো মানুষই মুক্ত নয়। কিন্তু ভুল শুধু একজন ব্যক্তির জীবনে নয়, দেশ ও জাতির জীবনেও চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এর ভূরিভূরি প্রমাণ দেখতে পাই। বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব আলীবর্দি খানের মৃত্যুর এক দিন আগে তাঁর ভুল সিদ্ধান্তে ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল তাঁর ছোট মেয়ের ছেলে মাত্র ২১ বছর বয়সের সিরাজউদ্দৌলা  নবাব হন। তার এক দিন পর ১০ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু নবাব হওয়ার মাত্র ১৫ মাসের মাথায় বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত এবং পরবর্তীতে তাদের হাতে নিহত হন সিরাজউদ্দৌলা। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। সেদিন নবাব আলীবর্দি খান তাঁর ছোট কন্যা ও তৎপুত্রের প্রতি অতিশয় স্নেহ বা প্রীতি দেখাতে গিয়ে যুবক ও অনভিজ্ঞ সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব মনোনীত না করে যদি কোনো অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিকে নবাব মনোনীত করতেন তাহলে আমাদের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। নবাব আলীবর্দি খানের বেশ কয়েকটি মারাত্মক ভুলের কারণে বাংলার ইতিহাস বড় কঠিন সময় নিয়ে রচিত হয়েছে। তিনি পারস্য থেকে নিঃস্ব অবস্থায় আসা মীর জাফরকে তাঁর প্রধান সেনাপতি বানিয়েছিলেন। অথচ ১৭৪৭ সালে মারাঠা যুদ্ধে মীর জাফর ওড়িশা থেকে পালিয়ে মেদিনীপুর চলে যান। আবার এই মীর জাফরকে বাঁচানোর জন্য আলীবর্দি খান নিজে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। শুধু তাই নয়, মীর জাফরকে সাহায্য করার জন্য যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তাদের নিয়ে মীর জাফর উল্টো আলীবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন। আলীবর্দি প্রথমে মীর জাফরকে বরখাস্ত করে পরে আবার পুনর্বহাল করেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, যে যুবককে আলীবর্দি খান বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব বানিয়ে গিয়েছিলেন সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫০ সালে আলীবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাটনা দখল করেন। যদিও পরে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

নবাব আলীবর্দি খানের এতসব ভুলকে ভুল বলার ক্ষমতা হয়তো সেদিন অনেকের ছিল না বা নবাবের চারপাশের চাটুকার ও তাঁবেদারদের দৌরাত্ম্যে হয়তো সম্ভব ছিল না। তা-ই যুগে যুগে হয়ে আসছে। তারপর সিরাজউদ্দৌলা সুযোগ পেয়েও ক্ষমার অযোগ্য ভুল করে ফেললেন, যার খেসারতে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। কাশিমবাজার কুঠিতে যখন ষড়যন্ত্রকারীদের হাতেনাতে ধরে ফেলা হয় তখন তাদের যদি বন্দি এবং ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হতো তা হলেও সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হতো না এবং বাংলা-বিহার-ওড়িশার স্বাধীনসত্তা হয়তো বিলুপ্ত হতো না। কিন্তু ভুল ভুলই। ভুলের কোনো সংশোধন হয় না। নবাব আলীবর্দি খানের ভুল সিদ্ধান্তে কীভাবে এ দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায় তার একটি পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হলো। 

ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ছিল যার সরকারি নাম ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৬০০ সালে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করেন। ৩১ ডিসেম্বর রানি এলিজাবেথের সনদবলে ওই কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। তারা ১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায় যা ছিল দুর্বল মুঘল সম্রাটের ভুলের ফসল। পরে অন্যান্য স্থানসহ হুগলিতে ইংরেজরা বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। ১৭১৫ সালে মুঘল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ওই মুদ্রা মুঘল সাম্রাজ্যেও চালু হয়। এ অনুমতি ভারতবর্ষের জন্য আত্মঘাতী ছিল। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে নেওয়ার পর ২০ জুন লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কলকাতা পুনরায় ২ জানুয়ারি, ১৭৫৭ দখল করেন। ক্লাইভ প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কেরানি ছিলেন পরে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজের যোগ্যতায় উঁচু পদ পান। ইংরেজরা চন্দননগর দখলের পর সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ প্রমুখের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে গোপন চুক্তি করে। চুক্তিমতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশী প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মেকি যুদ্ধ হয়। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তিমতো মীর জাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ৩০ লাখ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে ৩ লাখ টাকা আয় হতো। পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এদিকে তাঁর অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে।

 

ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে-তে এবং তখন তিনি ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি ১ আগস্ট, ১৭৬৫ লাভ করেন। শাহ আলম ছিলেন মুঘলদের সবচেয়ে দুর্বল সম্রাট। তখন দিল্লিতে একটি কথা ফারসিতে প্রচলিত ছিল- ‘সুলতানাত-ই-শাহ আলম, আজ দিল্লি তা পালাম’। বাংলায় যার অর্থ দাঁডায়- শাহ আলমের সাম্রাজ্য দিল্লি থেকে পালাম পর্যন্ত। পালাম হলো দিল্লির শহরতলি। সম্রাট শাহ আলম ১৭৬০ থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত দিল্লির সম্রাট ছিলেন। তাঁর থেকে সনদ পাওয়ার ফলে ইংরেজরা বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসনক্ষমতা লাভ করে যদিও তখনো বাংলায় নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থেকে যায়। ফলে পূর্ব ভারতের এ অঞ্চলে যে শাসনব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈতশাসন নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে।। তখন নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন আর এ সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬) সালে বাংলায় অনাবৃষ্টি হয় ফলে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। এটাই ইতিহাস-খ্যাত ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই। দেওয়ানি পাওয়ার পরপরই কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্য বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। ফলে বাংলার কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য ধরে রাখার ক্ষমতা ও অধিকার হারায়। ১৭৭৩ সালে ইংরেজরা রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস করে যার দ্বারা তারা বাংলা-বিহার-ওড়িশার জনগণকে নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করে। ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন করা হয় এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত বস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে বাংলার মসলিন ও তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইংরেজদের তথা বিলেতি টেক্সটাইল পণ্যের অবাধ বাজার খুলে দেওয়া হয়। ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা দেশের আমদানি ও রপ্তানি তাদের করায়ত্তে নেয়। এর ফলে ইংরেজদের কলকাতা বন্দর ছাড়া দেশি ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক বাণিজ্য করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে দেশি বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি ভাষা অফিস-আদালতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

 

১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কর রেয়াত দেওয়া হয়। বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশনের মূল সদস্যরাই ছিল ইংরেজ ফলে বাংলায় ব্যবসা করার জন্য ইংরেজদের কোনো কর দিতে হতো না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায়। ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ-দেশি অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলা নামের এ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ত হয় ১৮১৩ সালে। ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এক চার্টার অ্যাক্টবলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে দেশের শাসনভার কোম্পানির ওপর ন্যস্ত করে। পরের বছর কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।

 

সুদীর্ঘ ১৯০ বছর একচেটিয়াভাবে ইংরেজরা শাসন-শোষণ-ভোগ করতে পেরেছিল আলীবর্দি খানের কয়েকটি ভুলের কারণে। আজ যে ভারত ও চীন একচেটিয়াভাবে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে তার পেছনে মূল কারণ বিএনপির কতিপয় ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বিএনপি আদর্শগতভাবেই আওয়ামী রাজনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। বিএনপি কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করে না। বিএনপির রাজনীতি তার নিজস্ব বিশ্বাস ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যা দিয়ে গেছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপির শুরু বাংলাদেশ থেকে তাই প্রথম বাংলাদেশ-শেষ বাংলাদেশ হলো বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয়। বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক পরিচয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও অন্য নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শরিকদার। বিএনপি বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মুসলমানদের অন্যতম রাজনৈতিক দল। তাই বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ ও বহন করার মূল রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই দল যখন সর্বোচ্চ আসন পেয়ে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কাছে হাত পাতে তখন জনগণের কাছে ভুল বার্তা যায়। বিএনপি যখন টিকে থাকার সংগ্রামে সন্ত্রাসীদের দূরে রাখতে পারে না তখন বিএনপির চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিদেশি বন্ধুদের রাজনীতি ও তাদের অখন্ডতা-বিরোধী অবস্থানের বিপক্ষে বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থান বৈরী ও বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ শত্রুতার জন্ম দেয়। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যা-ই হোক না কেন ভুল আমাদের হয়েছে। যার নির্মম খেসারত আমরা দিচ্ছি।

 

আমাদের কোনো বন্ধু নেই। গত ২০ বছরে আমাদের পাশে কাউকে পাইনি। আমাদের ভুলের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে আমাদের প্রতিপক্ষ। আমাদের ভুলগুলো কাজে লাগিয়ে কিছু পরাশক্তি বাংলাদেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো লাফাচ্ছে দুর্নীতিবাজ আমলা, পুলিশ, প্রশাসন ও সুবিধাবাদী কিছু ব্যবসায়ী। বাতাস ঘুরে যাচ্ছে। দূর বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ দেখা যাচ্ছে যা যে কোনো সময় নিম্নচাপে পরিণত হয়ে আঘাত হানতেও পারে। প্রস্তুত থাকতে সমস্যা কী! অন্তত বেঘোরে তো মরতে হবে না। তা ছাড়া কথা আছে- শত্রুর শত্রু পরম বন্ধু। শত্রুর শত্রুদের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তামাক খাওয়ার আগুন পাওয়া যেতেও তো পারে! চোখ-কান খোলা রাখা তো বুদ্ধিমানের কাজ! অযথা বকবক না করে কিছুদিন চুপচাপ থাকলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে যা সময়ে কাজে আসবে!

 

পরিশেষে একটি চরম মনঃকষ্টের কথা বলতে চাই। পরিত্রাণ পাওয়ার সাধ্যি আমার নেই, তবে বলে রাখা আর কি! দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মহিলাটিরও তার সাধ্যমতো স্বাধীনভাবে চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার আছে। কারাগারে বন্দি থাকলেও তার যদি সাধ্য থাকে তাহলে বিদেশে উন্নত ও মনমতো চিকিৎসা নিতে যাওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চাইতে পারে, চাওয়ার অধিকার আছে এবং মানবিকভাবে সেই আবেদন বিবেচনা করার যথেষ্ট মানবিক গুণ দেশের সব বিচারকের আছে বলেও জনগণের বিশ্বাস। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র যে কোনো মায়েরই তার সাধ্যমতো বিদেশে গিয়ে স্বাধীনভাবে উন্নত ও মনমতো চিকিৎসার অধিকার আছে কিন্তু আমার মায়ের সে অধিকার নেই-নেই-নেই। জানি না আমরা কীসের আশায় বেঁচে আছি বা আমাদের বেঁচে থাকারই বা কী প্রয়োজন! মা আমাদের ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের চোখের সামনেই তিনি যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। মায়ের সব সন্তানের জানাজার আগাম দাওয়াত দিয়ে রাখলাম! সেদিন আমরা ঢাকা মহানগরীকে আমাদের নেতা-কর্মীদের মহাসমুদ্রে রূপান্তরিত করব!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» নির্বাচিত সরকারই দেশ পুনর্গঠন করতে পারে: তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

» ইয়াবাসহ দুইজনকে গ্রেফতার

» বদলে যাচ্ছে ফেসবুক মেসেঞ্জার

» সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

» রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার প্রয়োজন : সেলিমা রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বিগত সরকারের ভুলের চরম খেসারত

মেজর আখতার (অব.): মানুষ কখনই ভুল জেনেশুনে করে না। ভুল যখন করা হয় তখন তা যে ভুল হয়েছে তা যিনি করেন তিনি মেনেও নেন না। বরং ভুল ধরিয়ে দিলে বা ভুল হচ্ছে বললে যে বলে তার ওপর উল্টো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কিন্তু ভুল ভুলই। ভুলকে কখনই অস্বীকার করার জো নেই। ভুলের মাশুল দিতেই হবে। ভুল শুধু ব্যক্তিজীবনেই সীমাবদ্ধ নয়; ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতির ভুল হতে পারে এবং হয়। তাই ভুলের খেসারত যেমন ব্যক্তিকে দিতে হয়, তেমনি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, দেশ তথা জাতিকেও দিতে হয়। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরের ভুল ধ্বংস ও বিপর্যয় ডেকে আনে। এমন অনেক ভুল আছে যার সংশোধন করা আর কখনই সম্ভব হয় না। এজন্য বলা হয়, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।

 

ভুল কিন্তু শুধু একাই কেউ করে না। প্রতিটি ভুলের পেছনে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একপেশে স্বার্থ, অতিলোভ এবং ব্যক্তির দাম্ভিকতা প্রচন্ড ভাবে কাজ করে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা ব্যক্তির চারপাশে এমন একটি পরিবেশ ও অবয়ব সৃষ্টি করে যে, ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না, সে ভুল করছে। সব ভুলের কেন্দ্র কিন্তু ব্যক্তি। ভুলটা ব্যক্তিই করে। কিন্তু তার চারপাশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চাটুকার ও তাঁবেদাররা ব্যক্তিকে বুঝতেই দেয় না যে, ব্যক্তি ভুল করছে বা ভুল করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তি অনেক সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট চাটুকার ও তাঁবেদারের কারণে ভুল করতে বাধ্য হয়। মানবজীবনে ভুল একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় যা থেকে কোনো মানুষই মুক্ত নয়। কিন্তু ভুল শুধু একজন ব্যক্তির জীবনে নয়, দেশ ও জাতির জীবনেও চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এর ভূরিভূরি প্রমাণ দেখতে পাই। বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব আলীবর্দি খানের মৃত্যুর এক দিন আগে তাঁর ভুল সিদ্ধান্তে ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল তাঁর ছোট মেয়ের ছেলে মাত্র ২১ বছর বয়সের সিরাজউদ্দৌলা  নবাব হন। তার এক দিন পর ১০ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু নবাব হওয়ার মাত্র ১৫ মাসের মাথায় বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত এবং পরবর্তীতে তাদের হাতে নিহত হন সিরাজউদ্দৌলা। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। সেদিন নবাব আলীবর্দি খান তাঁর ছোট কন্যা ও তৎপুত্রের প্রতি অতিশয় স্নেহ বা প্রীতি দেখাতে গিয়ে যুবক ও অনভিজ্ঞ সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব মনোনীত না করে যদি কোনো অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিকে নবাব মনোনীত করতেন তাহলে আমাদের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। নবাব আলীবর্দি খানের বেশ কয়েকটি মারাত্মক ভুলের কারণে বাংলার ইতিহাস বড় কঠিন সময় নিয়ে রচিত হয়েছে। তিনি পারস্য থেকে নিঃস্ব অবস্থায় আসা মীর জাফরকে তাঁর প্রধান সেনাপতি বানিয়েছিলেন। অথচ ১৭৪৭ সালে মারাঠা যুদ্ধে মীর জাফর ওড়িশা থেকে পালিয়ে মেদিনীপুর চলে যান। আবার এই মীর জাফরকে বাঁচানোর জন্য আলীবর্দি খান নিজে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। শুধু তাই নয়, মীর জাফরকে সাহায্য করার জন্য যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তাদের নিয়ে মীর জাফর উল্টো আলীবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন। আলীবর্দি প্রথমে মীর জাফরকে বরখাস্ত করে পরে আবার পুনর্বহাল করেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, যে যুবককে আলীবর্দি খান বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব বানিয়ে গিয়েছিলেন সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫০ সালে আলীবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাটনা দখল করেন। যদিও পরে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

নবাব আলীবর্দি খানের এতসব ভুলকে ভুল বলার ক্ষমতা হয়তো সেদিন অনেকের ছিল না বা নবাবের চারপাশের চাটুকার ও তাঁবেদারদের দৌরাত্ম্যে হয়তো সম্ভব ছিল না। তা-ই যুগে যুগে হয়ে আসছে। তারপর সিরাজউদ্দৌলা সুযোগ পেয়েও ক্ষমার অযোগ্য ভুল করে ফেললেন, যার খেসারতে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। কাশিমবাজার কুঠিতে যখন ষড়যন্ত্রকারীদের হাতেনাতে ধরে ফেলা হয় তখন তাদের যদি বন্দি এবং ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হতো তা হলেও সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হতো না এবং বাংলা-বিহার-ওড়িশার স্বাধীনসত্তা হয়তো বিলুপ্ত হতো না। কিন্তু ভুল ভুলই। ভুলের কোনো সংশোধন হয় না। নবাব আলীবর্দি খানের ভুল সিদ্ধান্তে কীভাবে এ দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায় তার একটি পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হলো। 

ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ছিল যার সরকারি নাম ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৬০০ সালে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করেন। ৩১ ডিসেম্বর রানি এলিজাবেথের সনদবলে ওই কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। তারা ১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায় যা ছিল দুর্বল মুঘল সম্রাটের ভুলের ফসল। পরে অন্যান্য স্থানসহ হুগলিতে ইংরেজরা বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। ১৭১৫ সালে মুঘল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ওই মুদ্রা মুঘল সাম্রাজ্যেও চালু হয়। এ অনুমতি ভারতবর্ষের জন্য আত্মঘাতী ছিল। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে নেওয়ার পর ২০ জুন লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কলকাতা পুনরায় ২ জানুয়ারি, ১৭৫৭ দখল করেন। ক্লাইভ প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কেরানি ছিলেন পরে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজের যোগ্যতায় উঁচু পদ পান। ইংরেজরা চন্দননগর দখলের পর সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ প্রমুখের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে গোপন চুক্তি করে। চুক্তিমতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশী প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মেকি যুদ্ধ হয়। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তিমতো মীর জাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ৩০ লাখ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে ৩ লাখ টাকা আয় হতো। পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এদিকে তাঁর অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে।

 

ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে-তে এবং তখন তিনি ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি ১ আগস্ট, ১৭৬৫ লাভ করেন। শাহ আলম ছিলেন মুঘলদের সবচেয়ে দুর্বল সম্রাট। তখন দিল্লিতে একটি কথা ফারসিতে প্রচলিত ছিল- ‘সুলতানাত-ই-শাহ আলম, আজ দিল্লি তা পালাম’। বাংলায় যার অর্থ দাঁডায়- শাহ আলমের সাম্রাজ্য দিল্লি থেকে পালাম পর্যন্ত। পালাম হলো দিল্লির শহরতলি। সম্রাট শাহ আলম ১৭৬০ থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত দিল্লির সম্রাট ছিলেন। তাঁর থেকে সনদ পাওয়ার ফলে ইংরেজরা বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসনক্ষমতা লাভ করে যদিও তখনো বাংলায় নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থেকে যায়। ফলে পূর্ব ভারতের এ অঞ্চলে যে শাসনব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈতশাসন নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে।। তখন নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন আর এ সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬) সালে বাংলায় অনাবৃষ্টি হয় ফলে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। এটাই ইতিহাস-খ্যাত ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই। দেওয়ানি পাওয়ার পরপরই কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্য বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। ফলে বাংলার কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য ধরে রাখার ক্ষমতা ও অধিকার হারায়। ১৭৭৩ সালে ইংরেজরা রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস করে যার দ্বারা তারা বাংলা-বিহার-ওড়িশার জনগণকে নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করে। ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন করা হয় এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত বস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে বাংলার মসলিন ও তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইংরেজদের তথা বিলেতি টেক্সটাইল পণ্যের অবাধ বাজার খুলে দেওয়া হয়। ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা দেশের আমদানি ও রপ্তানি তাদের করায়ত্তে নেয়। এর ফলে ইংরেজদের কলকাতা বন্দর ছাড়া দেশি ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক বাণিজ্য করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে দেশি বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি ভাষা অফিস-আদালতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

 

১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কর রেয়াত দেওয়া হয়। বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশনের মূল সদস্যরাই ছিল ইংরেজ ফলে বাংলায় ব্যবসা করার জন্য ইংরেজদের কোনো কর দিতে হতো না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায়। ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ-দেশি অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলা নামের এ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ত হয় ১৮১৩ সালে। ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এক চার্টার অ্যাক্টবলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে দেশের শাসনভার কোম্পানির ওপর ন্যস্ত করে। পরের বছর কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।

 

সুদীর্ঘ ১৯০ বছর একচেটিয়াভাবে ইংরেজরা শাসন-শোষণ-ভোগ করতে পেরেছিল আলীবর্দি খানের কয়েকটি ভুলের কারণে। আজ যে ভারত ও চীন একচেটিয়াভাবে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে তার পেছনে মূল কারণ বিএনপির কতিপয় ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বিএনপি আদর্শগতভাবেই আওয়ামী রাজনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। বিএনপি কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করে না। বিএনপির রাজনীতি তার নিজস্ব বিশ্বাস ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যা দিয়ে গেছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপির শুরু বাংলাদেশ থেকে তাই প্রথম বাংলাদেশ-শেষ বাংলাদেশ হলো বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয়। বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক পরিচয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও অন্য নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শরিকদার। বিএনপি বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মুসলমানদের অন্যতম রাজনৈতিক দল। তাই বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ ও বহন করার মূল রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই দল যখন সর্বোচ্চ আসন পেয়ে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কাছে হাত পাতে তখন জনগণের কাছে ভুল বার্তা যায়। বিএনপি যখন টিকে থাকার সংগ্রামে সন্ত্রাসীদের দূরে রাখতে পারে না তখন বিএনপির চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিদেশি বন্ধুদের রাজনীতি ও তাদের অখন্ডতা-বিরোধী অবস্থানের বিপক্ষে বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থান বৈরী ও বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ শত্রুতার জন্ম দেয়। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যা-ই হোক না কেন ভুল আমাদের হয়েছে। যার নির্মম খেসারত আমরা দিচ্ছি।

 

আমাদের কোনো বন্ধু নেই। গত ২০ বছরে আমাদের পাশে কাউকে পাইনি। আমাদের ভুলের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে আমাদের প্রতিপক্ষ। আমাদের ভুলগুলো কাজে লাগিয়ে কিছু পরাশক্তি বাংলাদেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো লাফাচ্ছে দুর্নীতিবাজ আমলা, পুলিশ, প্রশাসন ও সুবিধাবাদী কিছু ব্যবসায়ী। বাতাস ঘুরে যাচ্ছে। দূর বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ দেখা যাচ্ছে যা যে কোনো সময় নিম্নচাপে পরিণত হয়ে আঘাত হানতেও পারে। প্রস্তুত থাকতে সমস্যা কী! অন্তত বেঘোরে তো মরতে হবে না। তা ছাড়া কথা আছে- শত্রুর শত্রু পরম বন্ধু। শত্রুর শত্রুদের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তামাক খাওয়ার আগুন পাওয়া যেতেও তো পারে! চোখ-কান খোলা রাখা তো বুদ্ধিমানের কাজ! অযথা বকবক না করে কিছুদিন চুপচাপ থাকলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে যা সময়ে কাজে আসবে!

 

পরিশেষে একটি চরম মনঃকষ্টের কথা বলতে চাই। পরিত্রাণ পাওয়ার সাধ্যি আমার নেই, তবে বলে রাখা আর কি! দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মহিলাটিরও তার সাধ্যমতো স্বাধীনভাবে চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার আছে। কারাগারে বন্দি থাকলেও তার যদি সাধ্য থাকে তাহলে বিদেশে উন্নত ও মনমতো চিকিৎসা নিতে যাওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চাইতে পারে, চাওয়ার অধিকার আছে এবং মানবিকভাবে সেই আবেদন বিবেচনা করার যথেষ্ট মানবিক গুণ দেশের সব বিচারকের আছে বলেও জনগণের বিশ্বাস। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র যে কোনো মায়েরই তার সাধ্যমতো বিদেশে গিয়ে স্বাধীনভাবে উন্নত ও মনমতো চিকিৎসার অধিকার আছে কিন্তু আমার মায়ের সে অধিকার নেই-নেই-নেই। জানি না আমরা কীসের আশায় বেঁচে আছি বা আমাদের বেঁচে থাকারই বা কী প্রয়োজন! মা আমাদের ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের চোখের সামনেই তিনি যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। মায়ের সব সন্তানের জানাজার আগাম দাওয়াত দিয়ে রাখলাম! সেদিন আমরা ঢাকা মহানগরীকে আমাদের নেতা-কর্মীদের মহাসমুদ্রে রূপান্তরিত করব!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com